Thursday, April 6, 2017

সম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস- "ঘাতক সম্মেলন"

                -১-

             সূত্রপাত

ড: সুদর্শন ভট্টাচার্য দেবীপুর কলেজে রসায়নের অধ্যাপক।তিনি বিজ্ঞানের সাধক হলেও আরও নানা দিকে তার আগ্রহ আছে।দেবীপুর শহরের গান্ধী ময়দানে যে বাৎসরিক “দেবীপুর বইমেলা” হয়ে থাকে তিনিই তার প্রধান উদ্যোক্তা।শহরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে তিনি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন।পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি খুব প্রিয়।শুধুমাত্র বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে তিনি পিকনিকে যান।কোনো পরীক্ষামুখী নয়,ছাত্রদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা গোড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেন।তাই তার টিউশন ক্লাসে হাইস্কুলের ছেলেরা শেখে শুধুই জ্যামিতির এক্সট্রা আর ইলেভেন টুয়েলভের ছেলেরা শেখে শুধুই ফিজিক্স এর অংক।কলেজের ছেলেদের তিনি টিউশন পড়ান না।

এই গল্পে আমরা ড: ভট্টাচার্য কে s.b. (এসবি) বলে সম্বোধন করবো।ছাত্রমহলে তিনি এই নামেই পরিচিত।

এসবির ওপর একটি আগ্রহের বিষয় হল গোয়েন্দা সাহিত্য।দেশী বিদেশী বিভিন্ন লেখকের গোয়েন্দা গল্প পড়া তার নেশা।এসবি সেদিন রবিবার বাজার যাচ্ছেন এমন সময় সন্দীপের সঙ্গে দেখা হলো।সন্দীপ তারই কলিগের ছেলে।ওর বাবা কলেজের ক্লার্ক।সন্দীপ দুর্গাপুরের একটি গভঃ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করে এখন একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করছে সল্টলেকে।সন্দীপ তাঁর কাছে একসময় পড়েছে,তাঁকে খুব শ্রদ্ধাও করে।সন্দীপ ও তাঁরই মতো রহস্য গল্পের পোকা।সন্দীপকে দেখে এসবি বললেন

“কেমন আছ?পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভালোই”

“আগামী রবিবার বাড়ি আসবে নাকি?”

সন্দীপ বললো “ স্যার আমি এখন বেশ কয়েকদিন ছুটিতে আছি।অনসাইট করার জন্য গত আটমাস UK তে ছিলাম তো।বাড়ি আসা হতো না তাই একটু বড় ছুটি নিয়েছি।”

“আগামী রবিবার একটি অনুষ্ঠান আছে আমার বাড়িতে।”কৃষ্টি কালচার”এর প্রোগ্রাম।এ ব্যাপারে কিছু ডিসকাস করার আছে তোমার সঙ্গে।বিকেলে একবার বাড়িতে এসো।অশেষ এর শরীর ভালো আছে তো?”

“বাবা ভালোই আছেন।সন্ধ্যেয় যাবো আপনার কাছে।”

“কৃষ্টি-কালচার”- এটি আর একটি পাগলামি এসবির।এর সঙ্গে কৃষ্টি বা সংস্কৃতির কোনো যোগ নেই!এটি আসলে শহরের আগাথা ক্রিস্টি ফ্যানদের একটি আড্ডা।এবং সভাপণ্ডিতের ভূমিকায় শ্রীসুদর্শন ভট্টাচার্য!ক্রিস্টির বিভিন্ন উপন্যাস,তার বিভিন্ন চরিত্র,পোয়ারো আর মিস মারপল  নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়।

christie- culture!

                 -২-

         সুদর্শন সমীপে

সন্দীপের দেশের বাড়ি দেবীপুরের পশ্চিমে উদয়পুর গ্রামে।সন্দীপের দাদু ছিলেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক  ব্যাক্তিত্ব।তার প্রভাবেই সন্দীপের বাবা দেবীপুরের কলেজে ক্লার্ক এর চাকরি পান।অথচ অশেষবাবু পড়াশুনায় যথেষ্ট ভালো ছিলেন, উচ্চ সম্ভবনা ছিল কিন্তু পিতৃআজ্ঞায় কেরানীর চাকরি নিয়ে দেবীপুরেই থেকে গেলেন।সন্দীপ মাধ্যমিক পর্যন্ত উদয়পুরে পড়েছে তারপর HS দেবীপুরে। ও যখন ক্লাস নাইন এ পড়ে তখনই অশেষবাবু দেবীপুরে বাড়ি বানান।সন্দীপের মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই ওরা দেবীপুরে শিফট করে। সুদর্শন ভট্টাচার্য্য এর বাড়ি কলেজের কাছে একটি নতুন গড়ে ওঠা পাড়ায়।এখানে কলেজের বেশিরভাগ অধ্যাপক বাড়ি করে থাকায় পাড়ার নাম হয়ে উঠেছে “প্রফেসর পল্লী”।এখানে মূলত সরকারি কর্মচারী , ধনী ব্যবসায়ী , শিক্ষকদের বাস।উচ্চ মধ্যবিত্ত পাড়া হিসাবেই পরিচিত এটি।

সন্ধ্যে ছটা নাগাদ সন্দীপ এসবির বাড়িতে পৌঁছলো।মাঝে মাঝে বাড়ি এলে সাইকেলটা চালানো হয়।সল্টলেকে এ সুযোগ পায় না ।এসবির বাড়ির বাইরে সাইকেলটি রেখে সন্দীপ বেল টিপলো।জানালা দিয়ে রবিঠাকুরের গান ভেসে আসছে।”কে দিল আবার আঘাত”।এসবি নিজেই দরজা খুললেন।হেসে বললেন “তোমার জন্যই গানটা চালিয়ে রেখেছি!”

রান্নাঘর থেকে অধ্যাপকজায়া আমিতাদেবী বেরিয়ে এলেন।

“কেমন আছো সন্দীপ?”

“ভাল আছি।আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো বাবা।তোমার জন্য চা করে রেখেছি ।দাঁড়াও দিচ্ছি।”

এসবি আর সন্দীপ ড্রইংরুমে বসলো।ড্রইংরুম না বলে লাইব্রেরি বলাই ঠিক হবে।দেওয়াল আলমারিতে অসংখ্য বই- দেশী, বিদেশী,বিজ্ঞান,সাহিত্য কি নেই  সেখানে!

এখন ও তিনি বই পড়ছিলেন।ইজি চেয়ারের পাশে ছোট টেবিলে শরদিন্দু অমনিবাস পড়ে আছে।

“ব্যোমকেশ পড়ছিলেন?”

এসবি হাসলেন।

“ আমার মতে “মগ্ন মৈনাক” এর মতো রহস্য উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর লেখা হয়নি।”

“ঠিক বলেছেন”

“জানো সন্দীপ আমার সেই সব রহস্য উপন্যাস বেশী ভাল লাগে যেখানে অতীত অপরাধের ছায়া বর্তমান জীবনে পরে।আর জানো তো অপরাধ কখনো চাপা থাকে না।যে অপরাধ অতীতের গর্ভে লুকিয়ে আছে তা অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে, সত্যসন্ধানীর অনুসন্ধিৎসায় আলোকিত হয়, উন্মোচিত হয়।”

“স্যার , আগাথা ক্রিস্টির “দ্য নেমেসিস” এ যেমন হয়েছিল।পুরানো অপরাধের শাস্তি পেয়েছিল অপরাধী।অপরাধীর নিয়তি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন মিস মারপল”

“নেমেসিস….নিয়তি!গম্ভীরভাবে বললেন এসবি।খুব প্রিয় শব্দ আমার।মগ্ন মৈনাকের অপরাধী তো ধরা পরে গেছিলো।কিন্তু আরও কত মগ্ন মৈনাক পাড়ায় পাড়ায় শহরে গ্রামে লুকিয়ে আছে তার ইয়াত্তা নেই।কত মানুষ অপরাধ করে পার পেয়ে যায় জানো?সমাজের দরকার একটা ব্যোমকেশ।যে অপরাধীর নিয়তি হয়ে দেখা দেবে,সমাজকে শুদ্ধ করবে।”

“এই বয়েসে তুমি কি ব্যোমকেশগিরি করবে নাকি?”

আমিতাদেবী চা আর বেগুনি নিয়ে ঢুকলেন।

“আরে না না ! এমনি কথা হচ্ছিল সন্দীপের সঙ্গে।”

চা রেখে আমিতাদেবী চলে গেলেন।

“শোনো সন্দীপ আগামী রবিবার আমি ছজন লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।তারা প্রত্যেকে এক একজন খুনি।তারা জীবনের কোনো না কোনো সময়ে কাউকে খুন করেছে।কিন্তু পার পেয়ে গেছে।কেউ ঘুনাক্ষনেও জানতে পারেনি যে সে ওই খুনের ব্যাপারে জড়িত।আমি তাদের কাছে আবেদন রাখবো তারা যেন তাদের অতীত অপরাধের কথা স্বীকার করে আর প্রায়চিত্ত স্বরূপ সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কিছু কাজ করে।নইলে তাদের নাম আমি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেব।”

চমকে উঠল সন্দীপ।

“কিন্তু কি বলে তাদেরকে ডাকবেন?আসল উদ্দেশ্য তো প্রথমেই বলা যায় না।তাহলে ওরা তো আসতেই চাইবে না।”

“এমনি সাহিত্য আলোচনা আসর এর নাম করে ডাকবো।তারপর ধীরে ধীরে আসল কথাটা বলবো।”

সন্দীপের মন কোনো এক অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল।

“স্যার অতীত অপরাধের কথা উত্থাপন করলে যদি ওরা violent হয়ে যায়।তাদের criminal instinct তো আবার জেগে উঠতে পারে।তারা আবার কোনো অপরাধ করে বসতে পারে।কোনঠাসা বেড়াল প্রাণের ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।”

“তখনই খেলাটি জমবে সন্দীপ।অপরাধী আর সত্যসন্ধানীর চোরপুলিস খেলায় এটাই তো মজা।প্রকৃত অপরাধী যখন জানবে যে সে সন্দেহের আওতায় পড়েছে তখনই সে নারভাস হয়ে পড়বে।প্রতিক্রিয়া দিতে সে বাধ্য।পুকুরে একটি ঢিল ফেলার অপেক্ষা।তরঙ্গ তৈরী হতে বাধ্য।”

সন্দীপ বুঝলো “রহস্য ক্রমেই ঘনিয়ে উঠছে।”

“স্যার আপনি কাদেরকে ডাকতে চলেছেন জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে”

“হ্যা।আমি তোমাকে একে একে তাদের কথা বলবো।”

                

                -৩-

               নট-নটী

প্রথমজন , এসবি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,ব্যাবসায়ী সুখেন সাহা।আমার পাড়াতেই থাকে।তুমি নিশ্চয় চেনো।”রাখী” সিনেমার মালিক।তা ছাড়াও কনস্ট্রাকশন এর ব্যবসা আছে।আমার সন্দেহ সে একটি অতীত অপরাধে যুক্ত।

“সুখেন সাহা কোন হত্যায় যুক্ত ছিল স্যার?”

“সেটা আমি বলবো না তোমাকে।এই ছজনের কারো ব্যাপারেই ওই তথ্যটি দেব না।তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, এখানে অনেকদিন আছো , বুদ্ধি খাটিয়ে বের করো।এতে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়েছো।কিছুটা তো শিখেছো সত্যসন্ধানের পক্রিয়া!”

“বেশ তাই হোক স্যার!” সন্দীপ হেসে বললো।

“দ্বিতীয়জন, অবিনাশ রায়।স্থানীয় দেবীপুর থানার ওসি।এর ব্যাপারে অবশ্য তুমি কমই জানো কারণ ভদ্রলোক মাত্র দু-বছর হল এখানে এসেছেন।ইনি ও একজন সন্দেহভাজন “মগ্ন মৈনাক”।”

“তৃতীয়জন এর নাম অজিত মুখার্জী।ভালো ফুটবলার, athlete.

এখন অবশ্য বয়স হয়েছে,খেলা ছেড়ে একটা গ্রোসারী দোকান খুলেছে।কলেজে আমার ছাত্র ছিল পাস কোর্সে।তোমাদের উদয়পুরের লোক।চেনো তো?”

“হ্যা,চিনি তো।আমি ক্লাস টেন অবধি উদয়পুরে পড়েছি।আজিতকাকুর খেলায় খুব আগ্রহ।আমাদের ছোটদের নিয়ে দৌড়,লং জাম্প এসব প্রাকটিস করাতো।আমার বিশ্বাস হয়না এরকম কোনো স্পোর্টসম্যান কাউকে হত্যা করতে পারে।”

“তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে ভাই।কিন্তু জীবনে মানুষ ক্ষনিকের আবেগ উত্তেজনায় এমনকিছু করে যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যাইহোক, চতুর্থজন হলো আমার প্রতিবেশী অরূপ সেনগুপ্ত।তুমি বোধহয় দু-একবার ওকে দেখেছ।আমার এখানে প্রায়ই আসেন,গল্প-গুজব হয়।স্থানীয় গ্রামীন ব্যাঙ্কে ক্লার্ক।

পঞ্চমজন রিন্টু মন্ডল।তোমাদের পাড়ায় থাকে।বড়বাজারে রেস্তোরাঁ আছে একটা।”ভালোমন্দ”।আর বাড়িতে ওর ওয়াইফ এর বিউটি পার্লার ।

তালিকায় শেষজন নেহাতই নিরীহ একজন বিধবা ভদ্রমহিলা।মলিনা মন্ডল।ওর মেয়ে আমার মেয়ের সঙ্গে পড়তো।সেই সূত্রে আমার বাড়িতে ওঁর যাতায়াত।তোমার কাকিমার সঙ্গে বান্ধবীর মতো সম্পর্ক।আগে তোমাদের উদয়পুরে থাকতো।এখন দেবীপুরে বাড়ি করে আছে।ওঁর হাসব্যান্ড এর একটা গ্রোসারি শপ আছে।”

চরিত্রায়নে বৈচিত্র্য আছে,সন্দীপ ভাবলো,ঐক্য ও আছে- অতীত অপরাধ।

                 -৪-

               সম্মেলন

“আমাকে কেন ডেকেছেন দাদা আপনাদের মধ্যে?আপনারা জ্ঞানী মানুষ ,বইপত্র পড়েন।আমি কি এসব কিছু বুঝি?চাষীর ঘরের মেয়ে ,সারাজীবন ভাতরান্না আর মুড়িভাজা

ছাড়া কিছুই করিনি।সাহিত্যসভায় আমার কীই বা করার আছে?”

মলিনা দেবী বলছিলেন।বসার ঘরের দেওয়ালে রহস্যের রানী আগাথা ক্রিস্টির একটি ফ্রেমে বাঁধানো ফটো রয়েছে।সোফায় বসে আছেন ওরা চারজন।

এসবি , সন্দীপ পাশাপাশি সেন্টার টেবিলের দৈর্ঘ বরাবর বড়ো সোফাটিতে।বাঁ দিকে সিঙ্গেল সোফায় অরূপবাবু , ডানদিকে আর একটি সিঙ্গল সোফায় মলিনাদেবী।

মলিনাদেবী একটু বোর হয়ে বললেন”আমার এখানে কোনো কাজ নেই, যাই দিদিকে একটু হেল্প করি”।

এসবি সন্দীপ কে বললেন

“সন্দীপ তুমি আর অরূপবাবু বারান্দা থেকে আর একটা সোফাসেট নিয়ে এসো।আরও চারজন আসবে।

থানার বড়বাবু  অবিনাশ রায় একজন দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ ব্যাক্তি।মুখটা ভাবলেশহীন।দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মাত্র সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন এসবি। বসালেন তার আর সন্দীপের মাঝে।

তারপর একেএকে এলেন সুখেন সাহা, রিন্টু দত্ত এবং অজিত মুখার্জী।

সুখেন সাহার ভারী  স্বাস্থ্য, পুরুগোঁফ।পোড়খাওয়া ব্যবসায়ীর চেহারা।

“আজকে জাতে উঠে গেলাম দাদা।”সুখেন সাহা হেসে বললেন “কারবারী লোককে সাহিত্যসভায় ডেকেছেন!”

রিন্টু মন্ডলের বয়স মোটামুটি ৪০-৪২,শ্যামবর্ণ ,রোগা চেহারা।মুখে একটা উপরচালাক ভাব।ঢোকামাত্র বোঝা গেল সে নিজেকে একটু “আউট অফ প্লেস” ভাবছে।

অজিত মুখার্জিকে এককথায় অ্যাথলেটিক বলা যায়।দীর্ঘদেহী,পেটানো চেহারা।শরীরচর্চার স্পষ্ট প্রমান শারীরিক গঠনে পাওয়া যায়।বয়স মোটামুটি রিন্টু মন্ডলের মতোই।আর্লি ফর্টিজ।সন্দীপকে দেখেই বললো “কি ভাইপো কেমন আছো ?”

“ভালো।”সন্দীপ হেসে বললো।

একরাউন্ড চা-জলখাবার পরিবেশন করলেন অমিতাদেবী আর মলিনাদেবী

মিলে।

তারপর শুরু হলো সভার কার্যক্রম।

এসবি বলতে শুরু করলেন”মাননীয় বন্ধুগন আজ আমি আপনাদের ডেকেছি একটি বিশেষ প্রয়োজনে।এটাকে একই সঙ্গে একটি সত্যসন্ধানের প্রক্রিয়া হিসাবেও দেখতে পারেন।আপনাদের যা খুশী।”

“আপনারা জানেন রসায়নের ছাত্র হলেও অপরাধ বিজ্ঞানের প্রতি আমার আজন্ম অনুরাগ।অপরাধ বিজ্ঞানের বই,  নিত্যদিনের সংবাদপত্রের অপরাধ ঘটিত খবরাখবর,চারপাশে সমাজের অপরাধ এবং সর্বোপরি কাল্পনিক গোয়েন্দাসাহিত্য আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে।অপরাধী মনস্তত্ব এবং অপরাধের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা আমার নেশা।আজকে আপনাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো আমার সেই সত্যসন্ধানের উদ্দেশ্যেই।”

এটুকু বলে শ্বাস নিলেন  এসবি।

“আর একটি উদ্দেশ্য আছে।সেটি হল “to give justice to a person or few persons who suffered in the past”

অতীতে হয়ে যাওয়া কিছু অন্যায় বা অপরাধকে সামনে আনা।”

সবার মুখ থমথমে।সবার দৃষ্টি এসবির দিকে।প্রথমে মুখ খুললেন ওসি অবিনাশ রায়।

“কিন্তু এসব কথা বাড়ির বৈঠকখানায় কিভাবে হতে পারে?এরজন্য তো পুলিশ আছে, আদালত আছে,আইন আছে।আপনি আইনের দ্বারস্থ হচ্ছেননা কেন?”

“অবিনাশবাবু আমরা যদি বিবেকবোধ জাগ্রত রাখি,আয়নায় নিজের আসল রূপটা দেখি তাহলে আইন,আদালত যাবার দরকার নেই।মনুষ্যত্ববোধ ও নীতিবোধই আমাদের সঠিক পথে চালিত করবে।”

‘বন্ধুগন আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে আমি জানি আপনাদের মধ্যে এমন কেউ একজন আছেন যিনি অতীতে এক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয় কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন।”

সকলেই চুপ।পিন ড্রপ সাইলেন্স।

সুখেন সাহা মুখ খুললেন।

“আপনি আমাদের এজন্য ডেকে পাঠিয়েছেন?বাড়িতে ডেকে অপমান করার একটা অভিনব পন্থা বেছেচেন তো আপনি।সাবাশ আপনাকে।”

রিন্টু মন্ডল বললো “আপনি ঠিক বলেছেন সুখেনদা।স্যার আপনি নিজেকে কি ভাবেন?মানুষকে এভাবে অপমান করছেন কেন?”

অজিত মুখার্জী মেঠো খেলোয়াড়ী মেজাজে বললো “কি ভেবেছেন কি নিজেকে?যাকে তাকে ডেকে অপমান করবেন?এত স্পর্ধা আপনার?সবাই চলুন এখন থেকে।ছোটলোক কোথাকার!”

সশব্দে বেড়িয়ে পড়লো সবাই।বাইরে থেকে উত্তপ্ত বাক্যালাপ ভেসে আসতে থাকলো।একটুপরে তা মিলিয়েও গেল সন্ধের অন্ধকারে।ঘরে শুধু এসবি, মলিনাদেবী,অরূপবাবু,সন্দীপ আর ওসি অবিনাশ রায়।অমিতাদেবী রান্নাঘর থেকে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা নেই।তারপর মলিনাদেবী বললেন

“আমি আসি দিদি।দেরি করলে আর রিকশা পাবো না।”

“আবার এসো মলিনা।”অমিতাদেবী বললেন।

স্মিত হাসলেন মলিনা।কোনো কথা বললেন না।লেডিস চপ্পল আর ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন।বোঝা গেল এসবির কথায় খুব একটা প্রীত হননি।

অমিতাদেবী তিরস্কারের সুরে বললেন “তোমার পাগলামি কবে থামবে বলতো?এভাবে লোকজনকে ডেকে এসব কথা বলে?ওই ষণ্ডাছেলেটা যদি গায়ে হাত তাত তুলতো তুমি কি করতে?তোমার কর্তৃত্ব কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এটা ভুলোনা।”

অবিনাশবাবু বললেন “বৌদি ঠিকই বলেছেন।আপনার এসব কথা বলা উচিত নয়।কারো এগেইনস্ট এ কিছু প্রমান থাকলে আমাকে দিননা, আমরা তদন্ত করে ঠিক দোষী সাব্যস্ত করবো।কোনো ক্রিমিনাল যদি জানতে পারে তার অপরাধের কথা আপনি জানেন তাহলে সে সাবধান হয়ে যাবে আর আপনার ক্ষতিও করতে পারে।”

“দারোগবাবু ঠিক বলেছেন।”আমিতাদেবী বললেন”এই বুড়োবয়সে তুমি এসব সামলাতে পারবে?সুখেন সাহার কত লোকাল গুন্ডা পোষা আছে তুমি জানো?রাতবিরেতে যদি আমাদের উপর চড়াও হয়।দারোগবাবুকি চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দেবে আমাদের?”

অরূপবাবু মাথা নেড়ে বললেন “সেসব চিন্তা নেই দিদি আমরা পাড়ার লোক থাকতে রিন্টু বা সুখেন সাহার গুন্ডারা কিছু করতে পারবে না।কিন্তু…..অবিনাশবাবু আপনি দেখলেন দাদা কথাটা শেষ করা মাত্র লোকগুলো কেমন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল।নিশ্চয় ওদের মনে কোনো অপরাধবোধ আছে।”

“না না অরূপবাবু।আপনি ভুল করছেন।কাউকে আপনি অপরাধী সন্দেহ করে বাড়িতে ডেকে সেটা বলতে পারেননা।প্রমান থাকলে পুলিশের কাছে যান।কেস করুন।দাদা আপনার মতো একজন responsible citizen এর এরকম কাজ অনুচিত হয়েছে।”

“ঠিক ,ঠিক।”অমিতাদেবী বললেন “এটা blackmail করার সামিল।তুমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষমা চেয়ে নিও।এসব না করে দুটো গরিব ছেলেকে পড়ালে তো পারো।”

“আহ!ওরা তো আমাকে বলতেই দিলনা।আমি বলছিলাম ওরা যেন অতীতের অপরাধের কথা স্বীকার করে নেয় আর সমাজকল্যাণমূলক কোনো কাজ করে তার প্রায়শ্চিত্ত করে।কিন্তু কথাটা শেষ করতে দিলোনা।”

“তোমার জাগ্রত বিবেক হবার কোনো দরকার নেই।বাস্তব আর সাহিত্যের কল্পলোক কখনো এক হয়না।নিজের পড়াশোনা আর কলেজ নিয়ে থাকো।এভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যেও না।”

               -৫-

            গর্ভঘাতিনী

           -–--------–----

রাতে বাড়ি ফিরে সন্দীপ খবরের চ্যানেলগুলো দেখছিলো।ছোট থেকেই নিয়মিত খবর ফলো করাটা ওর অভ্যেস।এসবির উপদেশে ইদানিং সে একটা business daily পড়ে আর business newschannel গুলো ফলো করে।এসবি বলেন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে সেই বিশ্লেষণ অনেক বৈষম্যমুক্ত হয়।অর্থনীতি লাভক্ষতির কেজো ভঙ্গিতে ভাবতে শেখায়।রাজনীতি আবেগ সর্বস্ব হতে প্ররোচিত করে।

সকালে সন্দীপ উঠলো একটু দেরিতে।প্রাতরাশ সারলো লুচি আর বেগুনভাজা দিয়ে।ছুটির দিনের আলস্য গায়ে মেখে সকালের নিউজপেপারটা নিয়ে বসলো।দশটার সময় লালচাঁদ দুধওয়ালা এসেছিল।সেই খারাপ খবরটা দিলো।

“তোমাদের উদয়পুরের গোপাল মোড়ল এখন এখানে বাড়ি করে থাকতো না?ওর বউ কাল রাতে বিষ খেয়ে মারা গেছে।”

“সেকি?”

“আমি সাইকেলে আসছিলাম।দেখি রাস্তার উপর একটা আম্বুলেন্স ঘিরে বাড়ির সবাই কাঁদছে।”

“শুনলাম ভোররাতে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।সকাল সাতটার মধ্যে সব শেষ।”

সন্দীপ স্তব্ধ হয়ে গেল মলিনাদেবীর মৃত্যুর খবরটা শুনে।দুপুরে ঠিকঠাক খেতে পারছিল না।কোনো মতে নাকে মুখে দুটি গুঁজে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো।এসবির বাড়ি পৌঁছে দেখে বাইরে একটি পুলিশের জিপ দাঁড় করানো।

ভিতরে যেতে দেখে ওসি অবিনাশ রায় কথা বলছেন।

“সব থেকে বড় ভয়ের ব্যাপারটাই ঘটলো।আপনার এভাবে এদেরকে ডাকা ঠিক হয়নি।এতে যারা মানসিক ভাবে দৃঢ় অপরাধী তারা আবার অপরাধ করবে-আপনার ক্ষতি করতে চাইবে।আর যারা মানসিকভাবে দুর্বল তারা suicide এর মতো escapist পথ বেছে নেবে।মলিনাদেবী was the most vulnerable of the lot.”

অবিনাশবাবু বলতে থাকলেন “আমি নিজে কিন্তু এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।আপনি আমার সামনে ভদ্রমহিলাকে তার পূর্ব অপরাধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।আমার কর্তব্য হলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আপনার এগেইনস্ট এ আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা আনা।আমি সেটা করছিনা।আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাকে কর্তব্য পালনে বাধা দিলো।”

অবিনাশবাবু দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন।এসবি চুপ, অমিতাদেবী ও চুপ।

এসবি মুখ খুললেন।

“আমি বুঝতে পারিনি মলিনা এরকম চরম পথ নেবে।”

“কিন্তু ও কি এমন করেছিল যার আত্মগ্লানিতে এই কাজ করল?”

“তোমার ওর মেয়ের কথা মনে আছে?”

“হ্যা।সে তো আমার বনির বন্ধু ছিল।সে ও suicide করেছিল।তাই তো….আত্মহনন এদের রক্তে।”

“আত্মহনন নয় ওর মৃত্যুটা ছিল একটা deliberate murder.”

“আঁ!তুমি কি বলছো?”

অবিনাশবাবুর দিকে চেয়ে এসবি বলতে শুরু করলেন ধরা ধরা গলায়।”হাসি ছিল আমার মেয়ে বনির সব থেকে প্রিয় বান্ধবী।গাঁয়ের মধ্যবিত্ত চাষীর ঘরের মেয়ে।সহজ,সরল,প্রগলভ এবং একটু বোকা।গ্রামের একটি বখাটে ছেলের পাল্লায় পরে সে।বিপথে যায় এবং গর্ভধারণ করে।সে ছেলেটি ছিল নিম্নবর্ণের একজন।রক্ষণশীল গ্রামীন সমাজে ঢি ঢি পরে যাবে এই আশঙ্কায় মিনতি নিজে হাতে তাকে বিষ দিয়ে মারে।”

“তুমি কি করে জানলে?আমি তো কখন ও আন্দাজ করিনি।”আমিতাদেবীর ধরা ধরা গলা।

“তোমার মনে আছে হাসির মৃত্যুর পর তুমি আর আমি উদয়পুর গেছিলাম।গিয়ে দেখলাম সবাই কান্নাকাটি করছে।কিন্তু যার মেয়ে সে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে আছে।বড় বিস্ময়কর লেগেছিল ব্যাপারটা।পরে অনেক কানাঘুষো শুনতে পেতাম।উদয়পুরের অনেক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার।তাদের বিভিন্ন কথায় আমার ধারণা আরও দৃঢ় হয়।”It was a case of honor killing”.পরে মলিনা আমার বাড়িতে এলে মেয়ের ব্যাপারে আলোচনায় ঢুকতেই চাইতোনা।”যে গেছে সে তো আর ফিরবে না”।এই ছিল তার কথা।অশিক্ষা,বর্ণভেদ প্রথা, ভ্রান্ত আত্মগরিমা একজন নিরীহ মানুষকে খুনীতে পরিণত করল।নিজের গর্ভের সন্তানের খুনী।”

-৬-

          মৃত্যু ছোঁয়াচে রোগ

পরদিন সকালে সন্দীপ ব্রেকফাস্টের পর একটু বের হলো।পাড়ার তেমাথার মোড়ের হার্ডওয়্যার দোকানের সামনে সাইকেলটা রেখে ভিতরে ঢুকলো।সন্দীপের বন্ধু রঞ্জিত এখন দোকানে বসে।তার সঙ্গেই পড়তো রঞ্জিত।পড়াশোনায় ভালো ছিল না।যদিও গোয়েন্দা গল্পের পোকা।ক্যারাটে, কুংফু এসব শিখতো।ক্যারাটের শো করতো।H.S. দেবার পর পৈতৃক ব্যাবসায় নেমেছে।ঘটে বুদ্ধি আছে কিন্ত পড়াশোনায় প্রবল অনীহা।

সন্দীপকে দেখেই রঞ্জিত হেসে উঠে দাঁড়ালো।

-কি ইঞ্জিনিয়ার বাবু কি মনে করে?

-ভালো আছিস?

-হ্যা।

রঞ্জিতের হাসি আর থামে না।হেসেই চলেছে মুখ টিপে।

-কি রে আমাকে কি জোকার মনে হচ্ছে?

-আররে নানা,একটা কথা মনে পরে গেল।তুই গোবর্ধন মন্ডল নামে কাউকে চিনিস?তোদের উদয়পুরের ছেলে।

-হ্যা।গবা আমার ক্লাসমেট তো।

-সেদিন আমাদের দোকানে এসেছিল।বললো  তোমার দোকানে মাঝে মাঝে সন্দীপকে দেখি।কিন্ত ও তো ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়েছে।শিক্ষানবিশী করতে হলে ওর তো রেডিও টিভির দোকানে বসা উচিত!

সন্দীপ হাসলো।

-হ্যা ভালো বলেছে।ও ছিল উদয়পুর স্কুলের বরাবরের সেকেন্ড বয়।আমাকে কোনোদিন হারাতে পারেনি।ওর বিদ্বেষ এখন ও কমেনি দেখছি!

-তারপর বল।

সন্দীপ কলেজের কথা বললো আর তার সঙ্গে এসবির বাড়ির ঘাতক সম্মেলন ও তার পরবর্তী মলিনাদেবীর মৃত্যু সবকিছু বললো।

-তোদের এই এসবি প্রফেসর জ্ঞানী লোক।কিন্তু কিছু পাগলামি আছে ওর।কি দরকার বল এভাবে খুঁচিয়ে ঘা করার।দিব্যি আছিস বাপু।বিনি পয়সায় টিউশন পড়াচ্ছিস, ছেলেপিলের উপকার করছিস।কিন্তু লোকজনকে ডেকে এইসব আঁতলামি করার কি দরকার?

-ব্যাপারটা এখন আর আঁতলামির পর্যায়ে নেই।সিরিয়াস টার্ন নিয়েছে।একটা মৃত্যু ইতিমধ্যেই ঘটেছে।

-হুঁম…

-আচ্ছা রঞ্জিত, তুই তো এখানে টানা থাকিস,তুই আমার থেকে এই লোকগুলোর ব্যাপারে অনেক বেশি জানিস।তুই একটু আমাকে বলতে পারবি বাকি পাঁচজন কি কোনো অপরাধমূলক কাজ করেছে অতীতে?করে থাকলে কোন মাপের?খুব বড় কিছু?অতীত অপরাধের ধরন জানতে পারলে বোঝা যাবে এরা এখন কতটা ডেসপারেট হইতে পারে নিজেদের কুকীর্তি ঢাকতে।

এমন সময় একটা বলিষ্ঠ চেহারার লোক হন্তদন্ত করে সাইকেল নিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ালো।সাইকেল থেকে না নেমেই বললো

-এই রঞ্জিত দোকান বন্ধ কর।

-কেন কি হয়েছে গদাই দা?

-ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি রিন্টু মন্ডল আর ওঁর বউ মারা গেছে কাল রাতে।আজ বাজার বন্ধ থাকবে।

-সেকি?কি হয়েছিল?

-কাল রাতে সুইসাইড করেছে।

মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু থেমে গেল।বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ওরা দুজনে।

দোকানের সাটার নামিয়ে তালা দিল সন্দীপ আর রঞ্জিত মিলে।

-চল রঞ্জিত এসবির বাড়ি যাবো একটু।

-আমি যাবো তোর সঙ্গে?

-আরে চলনা।

এসবির বাড়ির সামনে আসামাত্র দেখা গেল যথারীতি পুলিশের জীপ দাঁড়িয়ে আছে।ভিতর থেকে উত্তপ্ত বাক্যালাপ ভেসে আসছে।

এসবি সোফায় বসে আছেন,আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সুখেন সাহা,অজিত মুখার্জী আর ওসি অবিনাশ রায়।

“আপনার জন্য একটা সংসার ছারখার হয়ে গেল”।সুখেন সাহা মারমুখী মেজাজে বললো।

“জেনেশুনে একটা মানুষকে সুইসাইড এর দিকে ঠেলে দিলেন।আপনি একটা ক্রিমিনাল।”অজিত মুখার্জী ও সমানতালে ফুঁসছে।

“এখনই নিজেকে পুলিশের হাতে  তুলে দিন।দারোগবাবু , এর against এ আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করুন।

ওসি অবিনাশ রায় শান্ত করার চেষ্টা করলেন দুজনকে।

“আপনারা ওঁর উপর এভাবে চড়াও হবেননা।ধর্য্য ধরুন ।পাবলিক prosecutor মিঃ দাঁ এলে ওনার সঙ্গে ডিসকাস করে আমি স্টেপ নেব।”

সুখেন সাহা ও অজিত মুখার্জী ফুঁসতে থাকে সমানে।ভিতরের ঘরে অধ্যাপকজায়া শুয়ে আছেন।তাঁর শরীর ভালো নেই।low pressure এর রুগী।তার উপর এইসব ঝামেলা।

এসবি মৃদুস্বরে বললেন “অবিনাশবাবু আপনাকে একটা কথা বলা দরকার।আজ সকাল নটা নাগাদ একটা থ্রেট কল এসেছে ল্যান্ডফোনে।মিসেস ফোনটি ধরে ছিল।কেউ একজন বলেছে”আপনার স্বামীকে প্রস্তুত থাকতে বলুন “ব্ল্যাকমেইলিং এর শাস্তির জন্য।ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি এখনও।”আমার মিসেস ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।ও লো পেসারের রুগি।এখন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে।”

-বৌদি গলাটা চিনতে পারেননি?

-না।ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত গলায় কেউ কথা বলেছে।চিনতে পারেনি গলাটা।

অবিনাশবাবু স্থির দৃষ্টিতে অজিত মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে  বললেন “কি আপনারা কেউ করেছেন ফোনটা?”

অজিত মুখার্জী দাঁত চিপে বললো”আমি অন্তত পিছন থেকে ছুরি মারি না।যা করি সামনা সামনি করি।”

তখনই পাবলিক প্রসিকিউটর মিঃ দাঁ ঢুকলেন ঘরে।

অবিনাশবাবু ওনাকে বসতে বললেন।

“মিঃ দাঁ আমি আপনাকে মলিনা মন্ডলের কেসটার কথা বলেছিলাম না?আজ সকালে রিন্টু মন্ডল আর ওর ওয়াইফ ও সুইসাইড করেছে।যেহেতু রিন্টু ও সেদিন সুদর্শনবাবুর বাড়িতে ছিল তাই এটাও একই সূত্রে গাঁথা।এক্ষেত্রে কি আমার সুদর্শনবাবুর against এ action নেওয়া উচিত?”

মিঃ দাঁ একটু গম্ভীরভাবে ভাবলেন।তারপর বললেন

“না।এক্ষেত্রে abetting a suicide এর কেস দেওয়া যায় না।”

এটা শুনেই সুখেন সাহা আর অজিত মুখার্জী রেরে করে উঠে দাঁড়ালো।

“কি বলছেন আপনি?একজন শিশুও বুঝবে দুটো ঘটনাতেই ওনার ভূমিকা আছে।তা ছাড়া উনি আমাদের ও ডেকে মানসিক চাপ তৈরী করেছেন।উনি একজন প্রভাবশালী লোক বলে আপনারা কোনো স্টেপ নিচ্ছেন না।” সুখেন সাহা গর্জে উঠলো।

“আমি আপনার থেকে আইনটা ভালো বুঝি।এটা আমার পেশা।কাউকে তার কৃতকর্মের কথা মনে করিয়ে দেওয়া আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া নয়।আপনি যদি এব্যাপারে একমত না হন তাহলে আপনি নিজেই ওনার বিরুদ্ধে FIR করুন না।পুলিশ তদন্ত করবে।আমার মতে ডঃ ভট্টাচার্য নিরপরাধ।”

রাগে গজগজ করতে করতে ওরা দুজন বেরিয়ে গেল।মিঃ দাঁ এবার এসবিকে বললেন”এবার আপনি বলুনতো রিন্টু কি এমন করেছিল যে অনুশোচনায় এমন করলো।”

এসবি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন”রিন্টু আমার কলেজেই পাস কোর্সে পড়তো।অভাবের তাড়নায় graduation কমপ্লিট করতে পারেনি।তার আগেই ওর এক মামার কাছে চলে যায় দীঘায়।মামা অবশ্য সম্বন্ধেই।মোটে বছর ছয়েকের বড় হবে।তা সেই মামার এক হোটেল ছিল দীঘায়।রিন্টু সেখানে গিয়ে ওঠে মামা ও মামীর সংসারে।হোটেলের বাজারহাট, ব্যবস্থাপনা এসব দেখাশোনা করে।মামা ছিল শারীরিক ভাবে রুগ্ন,বিভিন্ন অসুখে ভুগতো।রিন্টু আসায় সুবিধাই হলো হোটেল দেখাশোনায়।রিন্টুর মামীমা মোটামুটি রিন্টুর সমবয়স্ক।রুগ্ন স্বামীর থেকে নবাগত ভাগ্নেটিকে তার বেশ মনে ধরে।দুজনে সিনেমা দেখা,সময় কাটানো চলতে থাকে পুরোদমে।ঘনিষ্টতা ক্রমেই প্রেমের রূপ নেয়।এইরূপে বিষবৃক্ষ মহীরুহে পরিণত হোলো দু এক বছরের মধ্যে।রিন্টুর মামার শরীর ক্রমশঃ রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হতে থাকে।হটাৎ একদিন মামা মারা যায়।কোনো গুরুতর  অসুখ হয়নি।পেটখারাপ,বমি থেকে মৃত্যু।যেহেতু লোকটা প্রায়ই রোগে ভুগত তাই কেউ সন্দেহ করেনি।কিছুদিনের মধ্যেই রিন্টু বিধবা মামীকে বিয়ে করলো।এতদিন যে মৃদু কানাঘুষো চলছিল সেটা কলরবে পরিণত হলো।বাড়ির কেউ ওদের সম্পর্ককে স্বীকার করলো না।ওরা দীঘায় হোটেল বিক্রি করে দেবীপুরে এসে সংসার পাতলো।আমি এইসব বৃত্তান্ত শুনেছি কালিদাস মন্ডল নামে একটি লোকের কাছে।লোকটা কিছুদিন দীঘার ওই হোটেলে রাঁধুনি ছিল।হোটেল বন্ধ হওয়ার পর এখানে ফিরে এসে আমাদের কলেজে অস্থায়ীভাবে পিওন এর কাজ করতো।ঘটনাটা শুনে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে রিন্টু আর তার মামীমা মিলে পথের কাঁটাটি নির্মূল করেছে।”

              -৭-

             মাস্টারমশাই

পাঁচমাথার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে আছে সন্দীপ আর রঞ্জিত।পড়াশোনায় রঞ্জিত দুর্বল হতে পারে কিন্ত সাধারণ বুদ্ধি ওর প্রখর।

“আচ্ছা রঞ্জিত, তোর কি মনে হয় ?এইযে চারজন এখনও বেঁচে আছে তাদের মধ্যে কে এই থ্রেট কলটা করতে পারে?”

“আমার সন্দেহ হয় অবিনাশবাবুকে।জানি ও নিজে পুলিশ বলে তোরা কেউ ওর দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিস না।কিন্তু ওকে ও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে।

আচ্ছা তুই কি জানিস অবিনাশ রায় এর বউ গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যায়।”

সন্দীপ চমকে উঠলো, তাই নাকি?

সন্দীপের নিজের উপরই রাগ হলো।সে অবিনাশবাবুকে কখনও হিসাবের মধ্যেই রাখেনি।কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়।সত্যসন্ধানের প্রথম আপ্তবাক্য হলো, কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা যাবে না।

“আচ্ছা সুখেন সাহার ব্যাপারে তোর কি মত?”

“ও একটা ধুরন্ধর ব্যবসায়ী।নিজের ধান্দায় কিছুটা নির্মম ও বটে।শহরের সব রাজনীতির লোক আর গুন্ডা শ্রেণীর লোক ওর হাতের মুঠোয়।ব্যবসায়িক স্বার্থে খুন জখম করে থাকতেই পারে।”

“জানিস রঞ্জিত,বাকি দুজনের ব্যাপারে কিন্তু আমি কিছুটা বিভ্রান্ত।”

“অজিত মুখার্জী আর অরূপ সেনগুপ্ত?”

“হ্যাঁ”

“কেন বলতো?”

“এদের দুজনকে কোনো অপরাধের ধারে কাছেও দেখিনি কোনোদিন।

আজিতকাকু বরাবর পরোপকারী লোক।আমি ছোট থেকে চিনি।বাচ্চাদের  খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়া এবং বিভিন্ন রকম সামাজিক কাজকর্ম,খেলাধুলার আয়োজনে সারাবছর ব্যস্ত থাকে।

অন্যদিকে অরূপ সেনগুপ্ত ও একজন নিরীহ প্রকৃতির ভদ্রলোক।জীবনহানি তো দূরের কথা কারো কেশাগ্র স্পর্শ করার মতোও সামর্থ নেই।”

রঞ্জিত বললো”এই দুজনের কিন্তু দুর্নাম হলে কিছু হারাবার নেই।কারণ এদের না আছে কোনো উচ্চ পদ না আছে কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা।পুরোনো অপরাধ প্রকাশ পেলে এদের হারাবার কিছু নেই।”

“তাহলে অজিত কাকু এত রেগে গেল কেন সেদিন?”

‘হু,সেটা ভাবতে হবে।তবে পুরনো অপরাধ প্রকাশ পেয়ে যাবার ভয় যদি কারো থাকে তবে সেটা ওসি অবিনাশ রায় আর সুখেন সাহার মধ্যে কেউ।”

“রঞ্জিত,তুই কিন্ত ভুল পথে যাচ্ছিস।আরও তথ্য দরকার সবার সম্মন্ধে।গোয়েন্দা গল্পে দেখিস না যাকে সবথেকে কম সন্দেহ করা হয় সেই দেখা যায় খুনি।”

“ওরে সন্দীপ এটা গোয়েন্দা গল্পের প্লট নয়, ঘোর বাস্তব।গল্পে পাঠক আর লেখকের দাবাখেলা চলতে থাকে।।সারা গল্পজুড়ে হাতি ঘোড়া নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে।গল্পের শেষে লেখক নিরীহ বোড়ে দিয়ে পাঠককে কিস্তিমাত করে।কিন্তু বাস্তবে প্রত্যাশিতভাবে যাকে অপরাধী মনে হয় শেষ পর্যন্ত সেই খুনি বলে প্রমাণিত হয়।

লালমোহন বাবুর কথাটা ভুলে যাস না!ট্রুথ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন!”

দুজনেই হেসে উঠলো।

এমন সময়ে ওদের সামনে দিয়ে একজন  লোক হেঁটে পেরিয়ে গেলো।লোকটি ওদের দুজনেরই বিশেষ পরিচিত।শুধু তাই নয় এসবির বাড়ির ঘাতক সম্মেলনের অংশগ্রহণকারী একজন সভ্য ও বটেন।লোকটিকে দেখামাত্র চায়ের দোকানের কয়েকজন ‘মাস্টারমশাই”, ‘মাস্টারমশাই’ আওয়াজ দিতে থাকলো।লোকটি ভ্রুক্ষেপ না করে কিছুদূর গেল।ছেলের দল টিটকিরির মাত্রা আরও বাড়ালো।হটাৎ লোকটি হিংস্রভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে তেড়ে এলো ওদেরদিকে।ছেলেগুলো চায়ের কাপ ফেলে যে যেদিকে পারলো পালালো।

লোকটি বিশ্রী গালাগালি দিতেদিতে চলে গেল।ততক্ষনে ছেলের দল ফিরে এসে তাদের অর্ধভুক্ত চা নিয়ে বসেছে আর হাসাহাসি করছে।

সন্দীপ রঞ্জিতকে বললো”এই মাস্টারমশাই এর বৃত্তান্ত টি কি?আমি তো কিছু শুনিনি এই ব্যাপারে?”

রঞ্জিত হেসে বলে”দিনরাত বইয়ে মুখে বসে থাকলে তোর এই অবস্থাই হবে।এই ঘটনা তো দেবীপুরের বাচ্চারাও জানে।’

তারপর ঘটনাটা পুরো বললো সন্দীপকে।

“এটা আগে বলিসনি কেনো?আপাত নিরীহ এই লোকটিকে  তো আমি সন্দেহই করিনি।কিন্তু এখন তো দেখছি একেও সন্দেহের আওতায় রাখতে হবে।”

          -৮-

         নিয়তি

 

অমিতাদেবীর শরীর ভালো নেই।একে লো প্রেসার এর রুগি উনি।তার উপর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে উনি খুবই বিচলিত।এখানে দেখাশোনার কেউ নেই বলে এসবি অমিতাদেবীকে বোলপুরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ওঁর বাপের বাড়িতে।বাড়িতে  তিনি এখন একা।

সন্দীপ ও এই কদিন বাড়িতেই  আছে।সন্দীপ আর রঞ্জিত মিলে ঠিক করলো ওরা এসবির বাড়ির উপর নজর রাখবে।এই কদিনে কিছু হয়নি মানে যারা অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে তারা মানসিক ভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী।রিন্টু মন্ডল বা মলিনা দেবীর মতো দুর্বলচিত্ত নয়।সেই অপরাধী বা অপরাধীরা জানে এসবি তাদের গোপন কথা জানেন।সেটা প্রকাশ পেলে তাদের সমূহ ক্ষতি।তাই তাদের প্রধান কাজ হবে এসবিকে রক্ষা করা।

এসবির বাড়ির পাশে পুরসভার পূর্ত বিভাগের অফিস।বাড়িটার দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে জুড়ে এই অফিস বিল্ডিং।পূর্বদিকে রাস্তা আর তার ওপারে ফাঁকা প্লট।কেবলমাত্র উত্তরদিকে বাড়ির লাগোয়া আর একটি বাড়ি।ওটা সন্তুদের বাড়ি।সন্তু সন্দীপ বা রঞ্জিতের থেকে কয়েক বছরের ছোট।কিন্ত ওদের  সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে।সন্তুর বাড়ির সবাই সিমলা বেড়াতে গেছে।বাড়িতে একা সন্তু আছে বাড়ি পাহারা দেবার জন্য।রঞ্জিত আর সন্দীপ মিলে ঠিক করলো সন্তুদের বাড়িতে থেকে তিনজনে মিলে নজর রাখবে এসবির বাড়ির উপর।কারণ যে ‘মগ্নমৈনাক’ তার কুকীর্তি ফাঁসের আশংকা করছে সে যেকোন মুহূর্তে বিপদজ্জনক কোনো পদক্ষেপ নিতেই পারে।সন্দীপের ষষ্ঠইন্দ্রিয় যেন বলছিল কিছু একটা হতে চলেছে খুব শিগগিরই।ওরা তিনজন পালাকরে সন্তু দের ঘরে থাকে এবং এসবির বাড়ির দিকে নজর রাখে।এ ব্যাপারে সন্দীপ এসবি কেও কিছু বলেনি।

সেদিন সন্ধ্যায় রঞ্জিত,সন্দীপ আর সন্তু আড্ডা দিচ্ছিল সন্তুদের ঘরে।এসবির বাড়ির দিকের জানলায় পর্দা টানা।আড্ডা মারতে মারতে কখন সাড়ে নটা বেজে গেছে কারোর খেয়াল নেই।হটাৎ সন্দীপ খেয়াল করলো এসবির বাড়ির গেটে হাফ শার্ট আর ট্রাউজার পরা একটা লোক একহাতে সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ভদ্রলোক তাদের পরিচিত।আরও স্পষ্ট ভাবে বললে বলতে হয় সেদিনের সেই চায়ের দোকানের ‘মাস্টারমশাই’।

লোকটিকে এই সময়ে দেখা মাত্র সন্দীপ সন্তু আর রঞ্জিত কে নিয়ে বাড়ির বাইরের দিকের বারান্দা সংলগ্ন ড্রইংরুমে গিয়ে দাঁড়ালো।রুমের আলো জ্বালেনি।পর্দার ফাঁক থেকে দেখতে থাকলো  কি হয়।

কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে এসবি বেড়িয়ে এলেন।

-আপনি এই অসময়ে?কি ব্যাপার?

স্বভাবে অতিথিপরায়ণ এসবির ভ্রু কুঁচকে গেছে কোনো এক অজানা বিস্ময়ে।

-এলাম দরকারে।আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

-এখন?ঠিক আছে আসুন।

দুজনে ভিতরে গেল।

-বলুন এবারে।

-আপনার সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া আছে।

-মানে?

-আপনি এভাবে মানুষকে নির্যাতন করেন কেন?

-কি বলতে চাইছেন?

-একজন মানুষের জীবনে কত রকম ঝড় ঝাপটা আসে জানেন?তার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকতে হয় যুদ্ধ করে।ছোটখাটো ভুল ত্রুটি মানুষের হয়েই থাকে।সেগুলোকে বড় করে দেখিয়ে তাদের ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করছেন কেন আপনি?

-আপনি সব গুলিয়ে ফেলছেন।কাউকে সচেতনভাবে মৃত্যুর দিকের ঠেলে দেওয়া ছোটখাটো ভুল নয়।এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।এ অপরাধ সর্বোচ্চ মানের শাস্তি দাবি করে।

-আপনি নিজেকে একাধারে জজ,জুরি, executioner  ভেবেছেন?

-আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করবো না।এখন আমার খাবার সময়।আপনি পরে আসুন।

-না,আজ একটা বোঝাপড়া করেই যাবো।আপনি মানুষের দুর্বলতার কথা জেনে দিনের পর দিন মানসিকভাবে নির্যাতন করবেন আর তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে?

-আপনার মনে অপরাধবোধ আছে বলেই আপনার এ রকম মনে হচ্ছে!

-কিসের অপরাধবোধ,কি অপরাধ করেছি আমি?খুন করেছি না ডাকাতি করেছি?

এসবি মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন।তারপর বললেন “ মনে পড়ছে না আপনার?একটা নিরীহ মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন,তার বাবা-মাকে সন্তানহারা করেছেন।মেয়েটি লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য শেষে বাধ্য হয়েছে  আত্মহত্যা করতে।”

“তবে রে শুয়োরের বাচ্চা।”

এই বলে লোকটি ঝাঁপিয়ে পরে এসবির উপর।দুহাতে চেপে ধরে তার গলা।এসবি প্রানপনে চেষ্টা করেন নিজেকে ছাড়াবার কিন্তু পারেননা।অস্ফুট এক কাতর স্বর বেড়িয়ে আসতে থাকে মুখ দিয়ে।

ঘটনার  আকস্মিকতায় নিশ্চল হয়ে যায় সন্দীপ,সন্তু আর রঞ্জিত।হটাৎ রঞ্জিত এক ঝটকায় সন্দীপের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে।ওদের সঙ্গে সন্তুও বেরোল বাইরে।দ্রুত ওরা এসবির দরজায় এসে ধাক্কা মারে।দরজাটা ভেজানো ছিল।ওদের আসার শব্দ শুনে লোকটা তখন এসবিকে ছেড়ে দিয়েছে।এসবি নিজের গলা ধরে বসে পড়লেন।ঘরে ঢুকেই সন্তু আর রঞ্জিত লোকটিকে চেপে ধরলো।হতবম্ভ হয়ে লোকটি বেশি বাধা দিলো না।সন্দীপ গিয়ে এসবির পাশে দাঁড়ালো।

এসবি খক খক আওয়াজ করতে করতে বললেন “একটু জল”

সন্দীপ ভিতরের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি একটা জলের বোতল নিয়ে এলো।

এসবি সেটা খেয়ে ধরা গলায় বললেন”তোমরা না এলে এ আমাকে মেরেই ফেলতো”

অন্যদিকে লোকটি কোনো কথা বললো না।দুহাতে মাথা ভর দিয়ে বসে রইলো।

সন্দীপ জানে এখন কি করতে হবে।বসার ঘরের এককোনে টেলিফোন ডিরেক্টরী থেকে দেবীপুর থানার নম্বর খুঁজে বের করলো।

সন্দীপ যখন টেলিফোনে থানায় ঘটনাটা জানাচ্ছে তখন ঘরের অন্যদিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আক্রমণকারী লোকটি।শূন্য,অসহায় তার দৃষ্টি।অতীত অপরাধের কলঙ্কের বোঝায় নতশির এই ‘মগ্নমৈনাক’ আর কেউ নয়, এসবির প্রতিবেশী অরূপ সেনগুপ্ত স্বয়ং।

               -৯-

             উপসংহার

         ------- ----------

আবার এসবির ড্রইংরুমে একত্রিত হয়েছে ওরা সবাই।অমিতাদেবী ফিরে এসেছেন।ওসি অবিনাশবাবু ,সুখেন সাহা,অজিত মুখার্জী আছেন।আর আছে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স সন্দীপ,রঞ্জিত আর সন্তু।শেষ দৃশ্যে ওরাই তো হিরো ছিল।

এসবি বলতে শুরু করলেন।

“অরূপ সেনগুপ্ত একজন নেহাতই সাধারণ লোক ছিলেন।আমাদের একটা চালু ধারনা আছে যে সাধারণ গেরস্থ, সংসারী লোক বুঝি কোনো অপরাধ করে না।যত অপরাধ করে গুন্ডা,বাদমাইস, রাজনৈতিক নেতা,পুলিশ আর ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা।”

এটুকু বলে তিনি অবিনাশবাবু আর সুখেন সাহার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।ওরাও হেসে ফেললো।

তারপর আবার শুরু করলেন।

তথাকথিত সাধারণ মানুষদের মধ্যে অনেকেই দৈনন্দিন জীবনে অনেক অনৈতিক কাজ করে।মলিনার কথা তো বলেছি তোমাদের।সে পারিবারিক সম্মানরক্ষার অজুহাতে নিজের গর্ভের সন্তানকে হত্যা করেছিল।

অরূপ সেনগুপ্ত ও সেরকম একজন দোষে গুনে ভরা লোক।গরিব বাড়ির ছেলে।গ্রামের ছেলে কলেজ পাশ করে গ্রামীন ব্যাঙ্ক এ একটা চাকরি জুটিয়েছিল।বাবা-মা খুব অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়ায় সংসারের বোঝা এসে পড়েছিল ঘাড়ে।বাড়তি রোজগারের আশায় টিউশন শুরু করলো।অংক আর সায়েন্স এর সাবজেক্ট পড়াতো।ধীরে ধীরে পসার বাড়লো।এই সময়েই রেলবাজারের যোগেন দত্তর বাড়িতে ওর একমাত্র মেয়েকে পড়াতে যেতো।ধনী ব্যবসায়ী যোগেন দত্ত তার মেয়ের পড়াশোনার ভার সপে দিয়েছিল অরূপ বাবুর হাতে।বড়োলোকের একমাত্র সুন্দরী আদুরে মেয়ে রাকা।অরূপ সেনগুপ্তর জীবনে এই ছাত্রীটি বিকেলে ভোরের ফুলের মতো দেখা দিল।

বলাই বাহুল্য অরূপবাবু ও চরিত্রের দিক থেকে ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেননা।কম বয়সে বৈবাহিক দায়িত্বের বোঝা চাপায় যৌবনের অনেক ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছিলো।সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার এমন অপূর্ব সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র অরূপবাবু নয়।ছাত্রীর সঙ্গে অরূপবাবুর মেলামেশা বেড়ে গেল।পড়ানো ছাড়াও একসঙ্গে ঘোরাঘুরি,রেস্তুরাঁয় খাওয়া এমনকি সিনেমা দেখা অবধি সবই চলতে থাকলো।শহরময় ওদের মেলামেশা নিয়ে নানা কথা চলতো।কিছু কথা যোগেনবাবুর ও কানে এসেছিল।কিন্তু উনি পাত্তা দেননি।এভাবে চলতে চলতে মেয়েটি একদিন বুঝতে পারে সে অন্তঃসত্বা।বাড়িতে বাবামাকে বলে সেটা।বাবা মা চাপ দিতে থাকে কে তার এই অবস্থার জন্য দায়ী সেটা জানার জন্য।অন্যদিকে অরূপবাবু  তার উপরে চাপ দিতে থাকলো যাতে সে কিছুতেই অরূপবাবুর নাম বাবামার কাছে না করে।দোটানায় হয়ে নিরুপায় হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সবাই চুপ করে শুনছিল।এসবি থামতেই সুখেন সাহা হাতজোড় করে বললো” আচ্ছা আমি তো কখনও কারোর মৃত্যুর কারন হইনি।আমাকে কেন ডেকেছিলেন সেদিন?ব্যবসার প্রয়োজনে ঘুষ দিয়েছি কখনো কখনো ,আইনও ভেঙ্গেছি।কিন্তু কখনও খুনখারাপি করিনি।

এসবি বললেন “কসাইপাড়ার একটা ছেলে আপনার কলকাতার ফ্ল্যাটে কাজ করতো না?ও কিভাবে মারা গেল?”

“ও আপনি জাহাঙ্গীর এর কথা বলছেন?ওকে তো টালিগঞ্জ এর পাড়ার ছেলেরা মেরেছিল।কিন্ত বিশ্বাস করুন আমার কোনো ভূমিকা ছিল না তাতে।জাহাঙ্গীর আমার ফ্লাট থেকে গয়না চুরি করে পালিয়েছিল।আমি লোকাল ক্লাবের ছেলেদের কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম ওর খোঁজ পেলে যেন আমাকে বা পুলিশকে জানায়।কিন্তু ওই যে বলে না ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে।ওরা জাহাঙ্গীরকে ট্রেস করেছিল।তারপর কথা কাটাকাটি হলে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।আমি গহনাগুলোও উদ্ধার করতে পারিনি।আমি ওদের গায়ে হাত দিতে বলিনি কখনও।বলেছিলাম পুলিশে হ্যান্ড ওভার করে দিতে।”

“ঠিক আছে আপনার কথা মেনে নিলাম।”এসবি বললেন।

এবার অজিত মুখার্জী বললেন “এবার বলুন আমাকে কি চার্জশীট দেবেন?”

-সতু বাবুর ছেলে তোমাদের উদয়পুরের একটা পুকুরে ডুবে মারা গেছিল তাই তো?

-ওটা একটা এক্সিডেন্ট।

-তোমার তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না?

অজিত মুখার্জী চুপ।

একটু ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো

“সৌমেন আমার সঙ্গে HS এ পড়তো।একবার উদয়পুরে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলো।দুপুরে আমি,সৌমেন আর গ্রামের কয়েকটা ছেলে মিলে একটা পুকুরে স্নান করতে গেলাম।ওখানে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা একটা খেলতে শুরু করলাম।পুকুরে একটা কাঠের পাটা ভাসছিল।আমরা গ্রামের ছেলেরা ওটার উপর ভেসে কে কতদূর যেতে পারি তার কম্পেটিশন করছিলাম।সৌমেন চুপ করে ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল।যেহেতু ও সাঁতার জানে না তাই কিছুতেই ওই খেলায় অংশ নেবে না।আমি এই নিয়ে ওকে ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করলাম।গ্রামের বাকি ছেলেরাও এতে যোগ দিল।বাধ্য হয়ে ও পাটাটার উপর চড়ে পুকুরের মাঝখান দিয়ে ভেসে চললো।পুকুরের মাঝামাঝি এসে পাটাটা হটাৎ উল্টে গেল।তার সঙ্গে সৌমেনও জলে পরে গেল।আমরা ঘাটের কাছ থেকে দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে গেলাম।যখন সৌমেন কে জল থেকে তুললাম তখন শরীরটা নিথর।”

অজিত মুখার্জী চুপ করে রইল।

অবিনাশবাবু এবার এসবির দিকে তাকিয়ে বললেন “আইনের রক্ষককে আপনি কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করার আগেই একটা স্বীকারোক্তি করি সবার সামনে।আমার স্ত্রী আরাধনা ছিল খুব মুডি মহিলা।আমার মায়ের সঙ্গে একটা ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে মান অভিমান হয় ওর।তার পরিপেক্ষিতে আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেয়।এতে কোনো অপরাধ জড়িয়ে নেই এ আমি হলপ করে বলতে পারি।”

এসবি ধীর কণ্ঠে বললেন “আমি জানি অবিনাশবাবু ,আপনার মতো সজ্জন ও সৎ পুলিশ অফিসার আমাদের শহরের অহংকার।”

তারপর সন্দীপদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন “এই তিনজনকে কিন্তু আপনি প্রশাসনের তরফ থেকে সম্বর্ধনা দিন।এরা প্রখর বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় দিয়েছে।অরূপবাবুর মতো নিরীহ লোকেরও যে অপরাধপ্রবণতা থাকতে পারে এটা কিন্তু এরা গেস করেছিল।আমার বাড়ির উপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছে।এরা ঠিক সময়ে না এলে আমি বাঁচতাম না।”

অবিনাশবাবু বললেন “ঠিক বলেছেন।আমি এসডিও আর পুরসভার চেয়ারম্যানকে বলে এদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করবো।ওদের মতো সাহসী ছেলে আমাদের গর্ব।”

সন্দীপের মুখ খুশিতে তৃপ্তিতে ভরে গেল।যাক এতদিন পর গোয়েন্দা গল্প পড়ার কোনো সুফল পেল!এসবির মতো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে,অরূপবাবুর মতো স্বভাব অপরাধীকে ধরিয়ে দিয়েছে।

সন্দীপের দৃষ্টি চলে গেল ঘরের দেওয়ালে রহস্যের রানী আগাথা ক্রিস্টির ছবির দিকে।ছবির নিচে লেখা ফিলিপ গিদেলার সেই অমর উক্তি “মহৎ মানুষের মনের খোরাক- গোয়েন্দা কাহিনী”।